Mira and others

ধারাবাহিক বড় গল্পঃ মীরা এবং অন্যরা

পরিচ্ছেদ ১।

মীরা আজ খুব সুন্দর করে সেজেছে। সূর্য এখনো ডুবেনি, কেবল কিছুটা পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। তবু চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। পশ্চিম আকাশটা জুড়ে ঘনকালো মেঘ। গুড়গুড় আকাশ ডাকছে সেই দুপুরবেলা থেকেই। বাতাসে বৃষ্টির আগাম ঘ্রাণ। বাতাসটাও আজ দুর্দান্ত পৌরুষ নিয়ে বইছে। দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিয়েছে মীরা। বাতাস যেন আজকে মীরাকে নিজের বুকে পাঁজাকোলা করে ছিনতাই করে নিয়ে যাবে। এরকম হলেই মীরার খুব সাজতে ইচ্ছে করে। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হলো না। দুপুরের খাবারের পর মীরা সাজতে বসেছিল। আয়নার সামনে বসে মীরা প্রথমে নিজেকে অনেকক্ষণ দেখে। সমসময় এটাই করে সে। চেহারাটা একটা ছবির ক্যানভাসের মত। কতরকম ভাবেই না এই ক্যানভাসে কত গল্প আঁকা যায়। মীরা জানে, মেকাপ দিয়ে শুধু চেহারার খুতগুলো নয়, মনের খুতগুলোকেও ঢেকে ফেলা যায়। খুব মন খারাপ হলে মীরা কড়া লাল রং এর লিপস্টিক দেয়। এমনিতেই সে টুকটুকে ফর্সা ধরনের মেয়ে। তারউপর যখন লাল লিপস্টিক ঠোঁটে পড়ে তখন আগুন যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। এমন মেঘ গুড়গুড়ে ঝাপসা বিকেলটা আজ বিনা কারণেই মন খারাপ করিয়ে দিচ্ছে। খুব করে সাজলে মীরার মন ভাল হয়ে যায়।

আয়নার সামনে প্রায় এক ঘণ্টা ঠায় বসে থাকার পর যখন সূর্য প্রায় পশ্চিমে হেলে পড়েছে, তখন মীরা সাজতে শুরু করলো। ওর কখনোই তেমন বেশী মেকআপ প্রয়োজন হয় না। খুব ফর্সা বলে ওকে ফাউন্ডেশন ব্যবহার করতে হয়না। হালকা একটু লিপস্টিক, দুচোখে কাজল, আর সামান্য ফেস পাউডার। এটুকুই মীরার সাজ। কিন্তু এটুকুতেই মীরা যেন মানুষের খোলস ছেড়ে অপ্সরী হয়ে ওঠে।

আজকেও মীরা অতটুকুই সাজলো। সুর্য ডুবে যাওয়ার কিছু আগে মীরা যখন বারান্দার ঝুল চেয়ারটায় বসলো তখন পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন ওর ওপর ভর করলো। ঘনকালো মেঘের ফাঁকে যে এক চিলতে শীতল আলো অবশিষ্ট ছিল তাও যেন আছড়ে পড়ছিল ওর পেলব গালে। চেয়ারটায় বসে মীরা একটা বহুদিনের বাসী ম্যাগাজিন বই হাতে নিতেই ঝুম বৃষ্টি নামলো। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বজ্রপাত হতে থাকলো। দুটো শালিক কি মনে করে এতক্ষণ মীরার বারান্দায় বসে ছিল। বৃষ্টি শুরু হতেই ডানা ঝাপটে অস্থিরতা শুরু করে দিল। ওর আর বারান্দায় বসা হলো না। ঝুল চেয়ারটা ছেড়ে তবুও মীরার উঠতে ইচ্ছে করছিল না। অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয়না। কিন্তু উঠতে হবেই। কে যেন অবিরাম বেল বাজাচ্ছে। শুনেও না সোনার ভান করে অনেকক্ষণ বসে থাকার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ওকে উঠতেই হলো। বেলটা যেভাবে বাজছে, এক্ষুনি দরজা না খুললে মনে হয় দরজাটা ভেঙ্গেই ফেলতে পারে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে মীরা দরজা খুলতে গেলো।

 

পরিচ্ছেদ ২।

দুপুরে একটা ইন্টারভিউ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য এমবিএ পাশ করে চাকরী  খুঁজে বেড়াচ্ছে মুহিব। ঢাকায় আজকাল ঢাকার ছেলেরাই চাকরী পাচ্ছে না, সেখানে মফস্বল থেকে আসা মুহিব অতি নগণ্য, এক্কেবারে সাধারণ। সহজে চাকরী পাওয়ার কোন কারণই তার নেই। যদিও ওর সিজিপিএ ভালোই, ৩.৭৫ সিজিপিএ নিয়ে মার্কেটিং মেজর করা মুহিব তবুও চাকরী পাচ্ছে না। এতে অবশ্য মুহিবের তেমন হতাশা নেই, তবে ইদানীং কিছুটা দুশ্চিন্তা হয়। বিশেষ করে রাতে বাড়ি ফেরার পর যখন জুতো জোড়ার দিকে চোখ যায়, তখন মুহিবের চোখ ফেটে কান্না আসে। এই শতচ্ছিন্ন জুতো পায়ে ইন্টারভিউ দিতে গেলে চাকরী পাওয়ার কোন কারণ নেই, কিন্তু আর কোন উপায়ও নেই। মুহিবের এই একটিমাত্র জুতো। আজকের ইন্টারভিউটাও মুহিব এই জুতো পড়েই দিতে গিয়েছিল। ইন্টারভিউটা ভালোই হচ্ছিল, কিন্তু হঠাত করেই একজন বোর্ড মেম্বার বললেন, “দেখুন, আমরা এমন একজনকে খুঁজছি, যিনি মার্কেটিং জানেন। আপনার জুতো দেখে মনে হচ্ছে আপনি মার্কেটিং এর বেসিকটাই জানেন না। মার্কেটিং এর ফোর পি থিউরিটা জানেন? ওখানে চারটা পি এর একটা হলো প্যাকেজিং। আপনার নিজের প্যাকেজিঙ এর যা অবস্থা, আপনি নিজেকে আমার কাছে কিভাবে মার্কেটিং করবেন বলুন তো?”  মুহিব প্রশ্নটা শুনে খুব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। আসলেইতো, এভাবেতো কখনো চিন্তা করা হয়নি। মুহিব যত দ্রুত সম্ভব ভাবতে লাগল। হঠাত করেই ওর মাথায় উত্তরটা এলো।

– স্যার, আমাকে একটা মনিট সময় দিন, আমি উত্তরটা দিচ্ছি।

– ঠিক আছে, আপনি ভেবে উত্তর দিন

মুহিব ঝট করে উঠে গিয়ে রুমের বাইরে গিয়ে জুতো জোড়া খুলে রেখে এসে আবার চেয়ারে বসলো।

– স্যার, চারটা পি এর মধ্যে, প্রথমটা প্রোডাক্ট, আমি নিজে। দ্বিতীয়টা প্রাইস, সেটা হলো আমার বেতন এবং সেলস কমিশন, যা আলোচনা সাপেক্ষ। আর তৃতীয়টা হলো প্রোমোশন, আমি আজকের এবং আগামী এক সপ্তাহের জন্য এই প্রোডাক্টের ফ্রি স্যাম্পল দিচ্ছি। স্যাম্পল টেস্টিং ফ্রি স্যার, পয়সা লাগবে না।

– আর প্যাকেজিং? ওই প্রশ্নটা এখনো জবাব পেলাম না। জুতো জোড়াই বা খুলে আসলেন কেন?

মুহিব এক গাল হেসে দিয়ে বললো

– স্যার, স্যাম্পল প্রোডাক্টের প্যাকেজিং, ব্র্যান্ডীং লাগে না। সেজন্যই জুতো খুলে আসলাম। মানে প্যাকেজিং থেকে প্রোডাক্ট বের করে কাস্টমারের ব্যাবহারের জন্য রাখলাম।  কাস্টমার প্রোডাক্ট পছন্দ করে যদি অর্ডার প্লেস করে তবেই কাস্টমারের টেস্ট এবং প্রাইস বুঝে প্রোডাক্টের প্যাকেজিং করে ফেলবো।

– ঠিক আছে আপনি বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। আপনার ইন্টার্ভিউ শেষ।

এরপর প্রায় তিনঘণ্টা মুহিবকে বসিয়ে রাখা হলো। এর মধ্যে মুহিব শীর্ষেন্দুর একটা উপন্যাস পুরো পড়ে শেষ করে ফেলল। বইটা পড়া শেষ হতেই রিসেপশনিস্ট মেয়েটা মুহিব কে বললো “এমডি স্যার আপনাকে ভেতরে যেতে বলেছেন। আসুন আমার সাথে”। এই বলে মেয়েটা মুহিবকে নিয়ে এমডি সাজ্জাদ সাহেবের  রুমে নিয়ে গেল।

– আপনার নাম মুহিব?

– জী স্যার।

– আপনার সম্পর্কে আমার হেড অফ মার্কেটিং কায়সার আমাকে বলেছেন। উনি আপনার উপর খুবই আশাবাদী। আমার এই কোম্পানিকে প্রায় শূন্য থেকে আজকে এতবড় করার পেছনে কায়সারের অবদান অনেক। আপনার ইন্টার্ভিউতে কি হয়েছে আমি জানি না। তবে কায়সার সাধারণত সোনা চেনে। ও আমাকে বলেছে আপনি একটা জুয়েল। আপনাকে আমি নিচ্ছি। কটা টাকা বেতন চাইছেন আপনি?

– স্যার বেতন বিষয়টা আপেক্ষিক। যেই টাকাটা আমার কাছে অনেক কিছু, সেটা আপনার কাছে খুবই সামান্য। তাই আমি আপনার কাছে চেয়ে নিলে ঠকে যেতে পারি। তাছাড়াও, অভিজ্ঞতায় আপনার কাছে আমি ধুলিসম। আমার মত একজন সদ্য পাশ করা মফস্বল থেকে আসা ভাসমান কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবকের বেতন আপনি যত ভাল মনে করেন ততই ঠিক আছে।

– কায়সার ভুল বলেনি দেখছি। বিয়ে করেছ?

– জ্বিনা স্যার। তবে মনে হয় এবার করা যাবে।

– বুঝেছি। পঁয়ত্রিশ হাজার মাসে, তার সাথে ফাইভ পারসেন্ট সেলস কমিশন। বিয়েটা যে এবার করা যাবে, খবরটা দিয়ে এসো। আর এইচ আর থেকে আয়পয়েন্টমেন্ট লেটার সই করে এডভান্স দশ হাজার টাকা নিয়ে যাও। আমার অফিসে ছেঁড়া জুতো আর ঘামে ভেজা শার্টের কোন অস্তিত্ব নেই। কাল থেকে জয়েন করছো তুমি।

 

অফিস থেকে বেরিয়ে এসে একটা বেনসন লাইট ধরালো মুহিব। মার্কেটে যেতে হবে। কিন্তু একা গেলে মুহিব কিছুই কিনতে পারবে না। কেনাকাটায় মুহিবের মত বোকা আর কেউ নেই। মুহিব জানে এই দশ হাজার টাকা ফালতু নষ্ট করা যাবে না। মুহিব ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকলো। সূর্য এখনো ডুবেনি, কেবল কিছুটা পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। তবু চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। পশ্চিম আকাশটা জুড়ে ঘনকালো মেঘ। যেকোন সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামবে। এর আগেই মুহিব কে নিকেতন পৌছুতে হবে। অনেকদিন দুজনে একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। আজকে ওকে চমকে দিতে হবে। বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। মুহিব দ্রুত পা চালালো। কিন্তু ওর বাসায় পৌছুবার আগেই ঝুম বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টিতে পুরো কাকভেজা হয়ে মুহিব কলিং বেল চাপল। কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। মুহিব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আরও কয়েকবার বেল চাপল। কেউ খুলল না। এক অজানায় আশংকায় মুহিবের বুকের ভেতর এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হলো। কলিং বেলের সুইচটা ধরেই থাকলো মুহিব। গায়ে শক্তি থাকলে আর মনে জোর থাকলে দরজাটা ভেঙ্গেই ফেলত হয়তো। কিন্তু মুহিব জানে, একটু পরেই এক অপরূপা সুন্দরী মায়াবিনী নারী দরজা খুলবে। তার মায়ায় মুহিব গত ছয়টি বছর আবিষ্ট।

 

(চলবে)

 

———————–
কপিরাইটঃ আশিক মজুমদার © ২০১৮। সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

এই গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে probhat.com এ। প্রভাতে প্রকাশিত যেকোন লেখা প্রভাতের কিংবা লেখকের পূর্ব অনুমতি ব্যাতিত অন্যত্র প্রকাশ করা কিংবা অন্য যেকোন মাধ্যমে কপি পেস্ট করা বাংলাদেশ কপিরাইট আইন দারা নিষিদ্ধ।

প্রভাতে প্রকাশিত সমস্ত লেখা বাংলাদেশ কপিরাইট আইন দ্বারা নিবন্ধিত। প্রভাত একটি বাংলা সাহিত্য বিষয়ক ওয়েব সাইট। এই ওয়েব সাইটে প্রকাশিত সমস্ত লেখা লেখকের ব্যাক্তিগত সম্পদ। লিখিত অনুমতি ব্যতিরকে এই সাইটের কোন লেখা কপি করা, পরিবর্তন করা, পরিমার্জন করা, ছাপানো ইত্যাদি সম্পূর্ণ বেআইনি এবং দণ্ডনীয়। প্রভাতের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে লিখুন এই ঠিকানায় admin@probhat.com